ভিএফএক্স কি: আধুনিক জীবনে ভিএফএক্স এর ব্যবহার এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
ভিজ্যুয়াল এফেক্টস বা ভিএফএক্স (VFX) বর্তমান সিনেমা জগতের একটি অপরিহার্য অংশ। এটি এমন একটি প্রযুক্তি যা ডিজিটাল উপায়ে এমন দৃশ্য বা ইফেক্ট তৈরি করে যা বাস্তবে ধারণ করা সম্ভব নয়। বর্তমান যুগের ব্লকবাস্টার মুভি, টিভি শো, এবং এমনকি বিজ্ঞাপনগুলিতেও ভিএফএক্সের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সিনেমা জগতে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে আজকাল আমরা এমন সব দৃশ্য দেখতে পাই, যা বাস্তব জীবনে দেখা সম্ভব নয়। এই অদ্ভুত এবং চিত্তাকর্ষক দৃশ্যগুলির পিছনে যেটি কাজ করে তা হলো ভিজ্যুয়াল এফেক্টস বা ভিএফএক্স। ভিএফএক্স এমন একটি প্রযুক্তি, যা সিনেমার দৃশ্যগুলিকে আরও জীবন্ত এবং বাস্তবসম্মত করে তোলে।
আমাদের প্রায় সবারই VFX নিয়ে আগ্রহ অনেক। হলিউড মুভিগুলো যখন দেখি আর অবাক হয়ে যাই কিভাবে এই কাজগুলো করা হয়। বাংলাদেশের মুভিতে কেনইবা এমন ইফেক্ট পাওয়া যায় না? অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি বিশেষ কারণ হলো Visual Effects কোন একটি সফটওয়্যার বা বিষয়ে আটকে নেই।
অনেকগুলো সফটওয়্যার মিলে তৈরি হয়ে ভিজুয়্যাল ইফেক্টস এর চমৎকার সব কাজ। আর বাংলাদেশে এই সফটওয়্যারগুলোর চর্চা নেই বললেই চলে। যে কারণে আমাদের দেশে এখনো তৈরি হয়নি কোন ভালো Visual Effects সমৃদ্ধ মুভি।
আজকে আমরা জানবো ভিএফএক্স, Visual Effects বা সংক্ষেপে vfx কাকে বলে, এর ব্যবহার, এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ইত্যাদি।
❏ ভিএফএক্স (VFX) কি?
ভিএফএক্স হলো কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি (সিজিআই) সহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করে বাস্তব জীবনে অসম্ভব এমন দৃশ্য তৈরি করা। এই প্রক্রিয়ায় কম্পিউটারের মাধ্যমে তৈরি করা হয় এমন সব দৃশ্য যা ক্যামেরায় সরাসরি ধরা সম্ভব নয়।
মুভিতে আমরা সাধারনত দুই ধরনের ইফেক্ট দেখতে পাই।
- Special Effects (SFX)
- Visual Effects (VFX)
Special Effects (SFX)হলো এমন ধরনের ইফেক্ট যা ক্যামেরার সামনে ঘটে। অর্থাৎ যা হাত দিয়ে ধরা যায়। আরো পরিস্কার করে বললে, ক্যামেরার সামনে যদি পেট্রোলের ড্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় তাহলে যে বিস্ফোরণ ঘটবে সেটাই হবে স্পেশাল ইফেক্ট।
Visual Effects (VFX)হলো এমন ধরনের ইফেক্ট যা পুরোপুরি কম্পিউটারে তৈরি করা হয়। কম্পিউটার গ্রাফিক্স (CG) বা Computer-generated imagery (CGI) ও বলা হয়ে থাকে। VFX ইফেক্ট তৈরি করা হয় টিউন প্রোডাকশনে। অর্থাৎ ক্যামেরা দিয়ে শুটিং শেষ করার পর VFX এর কাজ শুরু হয়। যেমন বিমান থেকে মানুষ পড়ে যাচ্ছে কিংবা কোন বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটছে ইত্যাদি সবই VFX দিয়ে করা হয়। দিন দিন প্রযুক্তির উন্নয়নে VFX জনপ্রিয় হচ্ছে।
VFX কে মুলত সহজে প্রকারভেদ করা যায় না কারন এর সংখ্যা অসংখ্য এবং অনেক গুলোর সাথে অনেক গুলো মিলে যায়। কিন্তু কিছু VFX কে প্রকারভেদে ফেলা যায় যাদের মধ্যে তেমন মিল নেই। একটি থেকে আরেকটি আলাদা।যথাঃ
❏ লাইভ অ্যাকশানঃএটি আমাদের কাছে অতিপরিচিত একটি ভিএফএক্স।এটি হলো মুলত Keying। অর্থাৎ কোনো ভিডিও রেকর্ডের সময় ব্লু স্ক্রীন(নীল কাপড়) অথবা গ্রীন স্ক্রীন(সবুজ কাপড়) ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে সেই ভিডিও এর ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভ করা হয়।
❏ ম্যাট পেইন্টিংঃএটি হলো লাইভ অ্যাকশান থেকে আরও বেশি উন্নত ভিএফএক্স।এটিতে কোনো প্রকার স্ক্রীন ছাড়াই বদলে দেয়া হয় ভিডিও এর ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে শুরু করে যে কোনো অংশ।এমন কি একটি Still Picture কে Motion Picture এ রুপান্তরিত করা যায়।
উদাহরণ সরূপ বলা যায় ধরুন আপনি একটি সমূদের ছবি তুললেন এবং অন্য কোথাও থেকে সমূদ্রের ঢেউ এর ভিডিও ডাউনলোড করে নিলেন। আপনি এই সমুদ্রের ঢেউ এর Movement টা আপনার সমূদ্রের ছবিতে ব্যবহার করে আপনার ছবিকেই ভিডিওতে রূপান্তর করতে পারবেন।
❏ ডিজিটাল এনিমেশনঃএনিমেশনও ভিএফএক্স এর মধ্যে পরে। এনিমেশন 2D বা 3D যেকোনোটা হতে পারে। মডেলিং,ট্যাক্সচারিং,রিগিং সব গুলই এই ডিজিটাল এনিমেশন এর অংশ। মুলত এই ভিএফএক্স এ কোনো ২ডি বা ৩ডি কনটেন্টকে ভিডিও এর সাথে যুক্ত করা হয়।
❏ সিজিআইঃVFX এর বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় রূপ হলো সিজিআই। যার ব্যবহার আপনার চোখকেও ধোঁকা দিতে পারে। কোনো জিনিসকে কম্পিউটার গ্রাফিক্স এর মাধ্যমে বাস্তবের সাথে মিল রেখে তৈরিই হলো সিজিআই। অর্থাৎ সিজিআই এ একটি বাস্তব মানুষকেও তৈরি করা যায় কম্পিউটার গ্রাফিক্স এর মাধ্যমে।
ভিএফএক্স প্রযুক্তি দিন দিন আরও উন্নত হচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির সমন্বয়ে ভিএফএক্স আগামী দিনে আরও উন্নত এবং বাস্তবসম্মত হবে। এর ফলে সিনেমা এবং গেমিং-এর অভিজ্ঞতা হবে আরও চমকপ্রদ এবং মনমুগ্ধকর।
❏ ভিএফএক্স-এর ব্যবহারঃ
ভিএফএক্স-এর ব্যবহার আজকাল সিনেমা, টেলিভিশন, বিজ্ঞাপন এবং গেমিং-এ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু উদাহরণ নিম্নরূপ:
সুপারহিরো সিনেমায়ঃ যেমন "অ্যাভেঞ্জার্স", "স্পাইডার-ম্যান" ইত্যাদি সিনেমায় ভিএফএক্স-এর ব্যবহার অসাধারণ।
ফ্যান্টাসি সিনেমায়ঃ "হ্যারি পটার", "লর্ড অফ দ্য রিংস" প্রভৃতি সিনেমায় ভিএফএক্স ব্যবহার করে জাদুকরী জগৎ তৈরি করা হয়েছে।
টিভি সিরিজেঃ "গেম অফ থ্রোন্স" সিরিজে ড্রাগন এবং অন্যান্য দৃশ্যগুলিতে ভিএফএক্স-এর বিস্ময়কর ব্যবহার দেখা যায়।
❏ VFX এ ব্যবহত সফটওয়্যারঃ
VFX এর অনেক সফটওয়্যার থাকলেও বিশেষ স্পেশাল ইফেক্টস (VFX) তৈরির জন্য প্রধানত কিছু পরিচিত সফটওয়্যার রয়েছে। এগুলো হলোঃ
- Adobe After Effects
- Adobe Premiere Pro
- Autodesk Maya
- Houdini
- Nuke
- Cinema 4D
- DaVinci Resolve
❏ Adobe After Effects:এডোবি এফ্টার এফেক্টস হলো একটি ডিজিটাল ভিজ্যুয়াল এফেক্ট, মোশন গ্রাফিক্স, এবং কমপোজিটিং অ্যাপ্লিকেশন যা Adobe Inc. দ্বারা ডেভেলপ করা হয়েছে। এটি সিনেমা, টিভি, ভিডিও, এবং ওয়েবের জন্য অ্যানিমেশন, ভিজ্যুয়াল এফেক্ট, এবং মোশন গ্রাফিক্স তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
❏ Adobe Premiere Pro:প্রিমিয়ার প্রো হলো একটি টাইমলাইন-ভিত্তিক ভিডিও সম্পাদনা সফ্টওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন যা Adobe Inc. দ্বারা ডেভেলপ করা হয়েছে। এটি ভিডিও সম্পাদকদের এবং কন্টেন্ট তৈরীকারকদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়, যারা সম্পাদনা, রঙ সংশোধন, অডিও পোস্ট-প্রোডাকশন, ইত্যাদি কাজ করেন।
❏ Autodesk Maya:মায়া হলো একটি ৩ডি কম্পিউটার গ্রাফিক্স অ্যাপ্লিকেশন যা Autodesk দ্বারা ডেভেলপ করা হয়েছে। এটি ইন্টার্যাক্টিভ ৩ডি অ্যাপ্লিকেশন, যেমন ভিডিও গেম, অ্যানিমেটেড ফিল্ম, টিভি সিরিজ, এবং ভিজ্যুয়াল এফেক্টস তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি শক্তিশালী মডেলিং, অ্যানিমেশন, সিমুলেশন, এবং রেন্ডারিং সুবিধা নিয়ে পরিচিত।
❏ Houdini:হুদিনি হলো একটি ৩ডি অ্যানিমেশন সফ্টওয়্যার যা SideFX দ্বারা ডেভেলপ করা হয়েছে, যা প্রোসেডারাল অ্যাপ্রোচ নিয়ে পরিচিত।
❏ Nuke:নিউক হলো একটি নোড-ভিত্তিক ডিজিটাল কমপোজিটিং এবং ভিজ্যুয়াল এফেক্টস অ্যাপ্লিকেশন যা The Foundry দ্বারা ডেভেলপ করা হয়েছে।
❏ Cinema 4D:সিনেমা ৪ডি হলো একটি ৩ডি মডেলিং, অ্যানিমেশন, এবং রেন্ডারিং সফ্টওয়্যার যা Maxon দ্বারা ডেভেলপ করা হয়েছে।
❏ DaVinci Resolve:দা ভিঞ্চি রিসলভ হলো একটি কালার করেকশন এবং নন-লিনিয়ার ভিডিও সম্পাদনা অ্যাপ্লিকেশন।
পরিশেষে, ভিএফএক্স সিনেমা জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এর মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা হয়েছে। সঠিক ব্যবহার এবং প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ভিএফএক্স আমাদের বিনোদন জগৎকে নিয়ে যাবে এক নতুন উচ্চতায়।