কিউআর কোড কি : কিভাবে কাজ কিউআর কোড ও বারকোড?
কিউআর কোড, বা কুইক রেসপন্স কোড, আধুনিক যুগের একটি জনপ্রিয় প্রযুক্তি। এটি প্রথমে জাপানের স্বয়ংচালিত শিল্পের জন্য পরিকল্পিত হয়েছিল, কিন্তু এখন এটি বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কিউআর কোডের মূল ধারণা, এর কার্যপ্রণালী এবং ব্যবহার।
কিউআর কোড হলো একটি দ্বিমাত্রিক বারকোড, যা স্ক্যান করার মাধ্যমে দ্রুত তথ্য পড়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। "কুইক রেসপন্স" নামটি এসেছে এর দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষমতা থেকে। এটি মেশিনে পাঠযোগ্য একটি কোড, যা সাধারণত সাদা পটভূমিতে কালো বর্গক্ষেত্র আকারে দেখা যায়।
একটি কিউআর কোড স্ক্যান করার সময়, স্ক্যানারটি কোডের আকার, প্যাটার্ন এবং অবস্থান শনাক্ত করে এবং সেই অনুযায়ী তথ্য পড়ে ফেলে। এই পদ্ধতিটি অত্যন্ত দ্রুত এবং নির্ভুল।
আপনারা কিউআর কোড এবং বারকোড অনেক স্থানে ব্যবহার হতে দেখেছেন নিশ্চয়। এগুলো আপনার যেকোনো পার্সেলের উপরে, কোন বইয়ের উপরে, কোন সফট ড্রিঙ্কের বোতলের উপরে কিংবা আপনার টি-শার্টের উপরে দেখতে পাওয়া যায়। বারকোড সাধারনত অনেক বেশি কমন হয়ে থাকে এবং এতে অনেক গুলো লম্বা লাইন দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া আজকের দিনে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা তো কিউআর কোড সম্পর্কে জানেনই। বিভিন্ন অ্যাপস ডাউনলোড করতে, অনলাইনে কোন সাইট ভিজিট করতে এই কোড আপনারা অবশ্যই ব্যবহার করে থাকবেন।
❏ বারকোড কি?
বারকোড হল তথ্য সংগ্রহের একটি ভিজুয়াল পদ্ধতি যা মেশিনযোগে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এটি সাধারণত এর ধারণকারী জিনিস সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করে। গতানুগতিক বারকোড হল কিছু অঙ্কিত সমান্তরাল লাইন-যার প্রস্থ এবং মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গার তারতম্য ভিন্ন ভিন্ন তথ্যের প্রতিনিধিত্ব করে; এটি রৈখিক বা একমাত্রিক ব্যবস্থা।
পরবর্তীতে আয়তক্ষেত্র, বিন্দু, ষড়ভুজসহ অন্যান্য জ্যামিতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে বারকোড ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়।যাকে ম্যাট্রিক্স কোড বা দ্বিমাত্রিক বারকোড বলা হয়।
যদিও তাতে প্রকৃতপক্ষে বার বা সরলরেখা ব্যবহৃত হয় না। প্রাথমিকভাবে বারকোড স্ক্যানার নামে বিশেষ অপটিকাল স্ক্যানার দিয়ে বারকোড স্ক্যান করা হত। পরবর্তীতে এমন কিছু সফটওয়ার তৈরি হয়েছে যা ক্যামেরা সম্বলিত স্মার্টফোনের ধারণকৃত ছবি পড়তে পারে।
বারকোডে লম্বা সাদাকালো রেখার ভেতরে কোন তথ্য সংরক্ষিত করা থাকে—এবং এখানে অনেক ছোট পরিমানের তথ্য সংরক্ষিত রাখা সম্ভব। কিন্তু কোন তথ্য সংরক্ষন করার পরে এথেকে অনেক সহজে সেই তথ্য রীড করাও সম্ভব, আপনাকে ম্যানুয়ালি কোন নাম্বার বা কোড প্রবেশ করানোর প্রয়োজন পরেনা, শুধু কোডটি স্ক্যান করলেই আপনি সকল তথ্য অ্যাক্সেস করতে পারেন।
আপনি যদি কোন দোকানের মালিক হয়ে থাকেন, তবে বারকোড আপনার প্রোডাক্ট ম্যানেজ করতে আপনাকে অনেক সাহায্য করে থাকবে।
মনে করুন আপনার দোকানে ১৫ ধরনের আইটেম রয়েছে, এবং প্রত্যেকের গায়ে আলাদা প্রকারের বারকোড রয়েছে। এখন যখন কোন প্রোডাক্ট বিক্রি হবে, তখন আপনার দোকানের কর্মচারী সেই কোড স্ক্যান করে সহজেই সেই প্রোডাক্টের দাম, সেই প্রোডাক্টটি আর কতটা স্টকে রয়েছে, কতটা বিক্রি হয়েছে ইত্যাদি তথ্য জানতে পারা সম্ভব হবে।আপনি একজন গ্রাহক হিসেবে আপনিও সেই প্রোডাক্টটির গায়ের কোড স্ক্যান করে অনেক তথ্য যেমন, প্রোডাক্টটির প্রস্তুতকারী কোম্পানির নাম, প্রোডাক্টটির তৈরি হওয়ার তারিখ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারেন।
এখন কথা বলি বারকোড রিডার নিয়ে, এটি কীভাবে কাজ করে তার সম্পর্কে। দেখুন বারকোডের ভেতরে সাধারনত কোন নাম্বার স্টোর করা থাকে—অর্থাৎ ০ থেকে শুরু করে ৯ পর্যন্ত যেকোনো নাম্বার এতে সংরক্ষিত থাকতে পারে, এবং সেই নাম্বার গুলো বিভিন্ন সন্নিবেশে থাকতে পারে। প্রত্যেকটি লম্বা লম্বা লাইনের মধ্যে আলাদা আলাদা নাম্বার সংরক্ষিত করা থাকে। এখন যে স্ক্যানার থাকে সেখান থেকে একটি লেজার লাইট ঐ কোডটির দিকে ছুড়ে মারা হয়। কোডটির যেখানে কালো রেখা থাকে সেখান থেকে কোন প্রতিফলন স্ক্যানারে ফিরে আসেনা এবং সাদা অংশ থেকে আলো প্রতিফলন ফিরে আসে। এখন যেখানে থেকে আলো আসছে না সেটাকে ০ এবং যেখান থেকে আলো ফিরে আসে সেটাকে ১ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এখন এই নাম্বার গুলোকে বিভিন্ন সেগমেন্টে বিভক্ত করার মাধ্যমে সহজেই স্ক্যানারে থাকা রিসিভারটি কোডটি পড়তে পারে।
এই বারকোডে লুকিয়ে থাকা তথ্য পড়ার জন্য আগে অনেক বড় আকারের বাল্ব ব্যবহার করা হতো—কিন্তু বর্তমানে একটি হাতের সাহায্যে পরিচালিত স্ক্যানার থাকে এবং সেখান থেকে একটি লেজার রশ্মি ছুড়ে মারা হয়ে থাকে এবং এর মাধ্যমেই অনেক সহজেই বারকোড রীড করা সম্ভব হয়ে থাকে। কিন্তু , বারকোডে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন ধরুন, বারকোডে যদি কোন দাগ পড়ে বা কেটে যায় তাহলে সঠিক তথ্য বের করতে মুশকিল হতে পারে, এবং দ্বিতীয়ত এই কোডে অনেক কম পরিমানে তথ্য সংরক্ষন করা যায়। আর এই সমস্যা গুলো অবসান করানোর জন্য আমরা ব্যবহার করে থাকি কিউআর কোড (QR Code)। চলুন এবার এর সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
❏ কিউআর কোড কিঃ
যেকোনো প্রোডাক্টের গায়ে, টিকিটের গায়ে, কোন পত্রিকার বিজ্ঞাপনের উপর বা অনলাইনে কোন ওয়েবসাইটে অবশ্যই কিউআর কোড ব্যবহার হতে দেখেছেন। এই কোডে অনেকগুলো ডট ডট থাকে এবং সম্পূর্ণ কোডটি একটি চারকোনা ঘরের মধ্যে অবস্থিত থাকে। সাধারন বারকোডের মতো এটিও কোন স্ক্যানার দিয়ে পড়া সম্ভব, তাই অতি সহজেই এ থেকে সংরক্ষিত তথ্য গুলো বের করে আনা সম্ভব হয়ে থাকে।
কিউআর কোডকে টু ডাইমেন্সনাল বারকোড বা ২ডি বারকোডও বলা হয়ে থাকে। সাধারন বারকোডে এদের রেখাংশের মধ্যে তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়, কিন্তু কিউআর কোডে এর সাদাকালো এবং একসাথে অনেক ডট ডটের মধ্যে অনেক বেশি তথ্য রাখা সম্ভব হয়ে থাকে। এই কোড কীভাবে কাজ করে তা জানার আগে চলুন জেনে নেওয়া যাক, এর ব্যাবহারের বিশেষ সুবিধা গুলো সম্পর্কে।
❏ ২ডি বারকোড ব্যাবহারে সুবিধা সমূহঃ
আরো তথ্য সংরক্ষনঃ হ্যাঁ , কিউআর কোডে একসাথে অনেক তথ্য সংরক্ষন করে রাখা সম্ভব হয়ে থাকে। সাধারন বারকোডে লম্বালম্বি ভাবে কালো রেখা দেওয়া থাকে ফলে এতে বেশি তথ্য সংরক্ষিত রাখা সম্ভব হয়ে থাকে না—সাধারনত ডজন খানেক ডিজিট সংরক্ষন করা সম্ভব হয়ে থাকে (যদি এই ডজন খানেক ডিজিট কোন প্রোডাক্ট চিনতে যথেষ্ট, কিন্তু তারপরেও অনেক কাজ করা সম্ভব নয়)। সাধারন বারকোডকে লম্বা না করলে এতে আরো বেশি তথ্য আঁটানো সম্ভব হয়না। কিন্তু ২ডি বারকোড বা কিউআর কোড চারকোনা হওয়ার ফলে এবং দুইদিক থেকে এর তথ্য অ্যাক্সেস হওয়ার ফলে একে আকারে না বাড়িয়েই অনেক বেশি তথ্য সংরক্ষন করা সম্ভব। সাধারনত এটি ২ডি বারকোড ২০০০ অক্ষরে কোন তথ্যকে চিত্রিত করতে পারে।
কম ভুল হয়ঃ সাধারন বারকোডের কোন অংশ নষ্ট হয়ে গেলে বা এতে দাগ পড়ে গেলে এথেকে কোন তথ্য বের করে আনা অনেক সমস্যা হয়ে পড়ে। কেনোনা এতে তথ্য সংরক্ষিত রাখার জন্য শুধু কয়েকটি লম্বা রেখা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এতে কোন তথ্য ব্যাকআপ রাখার কোন সিস্টেম থাকেনা। কিন্তু ২ডি বারকোডে একই তথ্য আলাদা ফর্মে একাধিকবার সেভ করা থাকে। ফলে একটি তথ্য অ্যাক্সেস না হলেও আরেকটি থেকে এর তথ্য পাওয়া যায়। তাই কোড ক্ষতিগ্রস্থ হলেও কিউআর কোডে কোন সমস্যা হয়ে থাকেনা।
তথ্য পড়া অনেক সহজঃ ২ডি বারকোড গুলো স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট কম্পিউটারের ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করে অতিসহজেই পড়া সম্ভব। তাই কিউআর কোড পড়তে কোন স্পেশাল স্ক্যানারের প্রয়োজন পড়েনা। এই কোডে অনেক বেশি তথ্য থাকার পরেও একে অনেক দ্রুত পড়া সম্ভব হয়ে থাকে।
প্রেরন করা অনেক সহজঃ কিউআর কোডকে সাধারন ম্যাসেজের মাধ্যমে এক সেলফোন থেকে আরেক সেলফোনে পাঠানো সম্ভব।
আরো নিরাপদঃ এর ভেতরে সংরক্ষিত থাকা ডাটা গুলো ইনক্রিপটেড করে রাখা সম্ভব তাই এটি সাধারন কিউআর কোড থেকে আরো বেশি নিরাপদ।
❏ কিভাবে QR কোড তৈরি করবেন ফ্রি?
কিউআর কোড তৈরি করার জন্য অনেক সফটওয়্যার, অ্যাপ বা ওয়েবসাইট রয়েছে। তবে আপনারা চাইলে আমার তৈরি QR কোড ওয়েবসাইটি ব্যবহার করতে পারেন লিংকঃ
এখানে ক্লিক করুনএই লিংক থেকে আপনি ফ্রিতে QR কোড তৈরি করতে পারবেন এবং তা ডাইনলোড করতে পারবেন।
❏ ডাইনামিক QR কোড কি?
যে কিউআর কোড তৈরি হয়ে যাবার পরেও তার ভেতরের তথ্য পরিবর্তন করা যায় তাকে ডাইনামিক QR কোড বলে। ধরুন কোন একটি প্যাকেটের দাম ৪০টাকা, এই কথাটি লিখে QR কোড বানিয়ে তা প্যাকেটের গায়ে সিল মেরে দিয়েছেন।
ধরুন আপনি বিস্কুট বিক্রির জন্য বাজারে পাঠানো হয়ে গিয়েছে, এমন সময় আপনি বিস্কুটের দাম বাড়িয়ে দিলেন। আর ঐ বিস্কুটের প্যাকেটের গায়ের আগের QR কোডই কেউ স্ক্যান করে দেখলো যে বিস্কুটের দাম ৫০ টাকা হয়ে গিয়েছে। খেয়াল করুন এখানে কিন্তু QR কোড একই রয়েছে, কিন্তু স্ক্যান করলে আগের দাম না দেখিয়ে বর্তমানের দাম দেখাচ্ছে।
এটিই হল ডাইনামিক কিউআর কোডের উদাহরণ। ডাইনামিক QR কোডের তথ্য দেখতে হলে মোবাইলে অবশ্যই ইন্টারনেট কানেকশন থাকতে হবে।
❏ ডাইনামিক QR কোড কিভাবে কাজ করে?
আপনি যখন কোন ডাইনামিক QR কোড স্ক্যান করেন মোবাইল দিয়ে তখন আপনাকে একটি ওয়েবসাইটের লিংক দেখায়, যেখানে ক্লিক করলে QR কোডে থাকা বিস্তারিত লিখা দেখা যায়। তারমানে ডাইনামিক QR কোডের ভেতরে সংরক্ষিত সকল তথ্য কোন ওয়েবসার্ভারে সংরক্ষিত থাকে।
যখন কেউ উক্ত ওয়েবসার্ভারে থাকা তথ্য চেঞ্জ করে দেয়, তখন কেউ উক্ত QR কোড স্ক্যান করলে ঐ একই ওয়েবসার্ভারে থাকা পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া তথ্য দেখা যায়। ডাইনামিক QR কোডের সকল তথ্য যেহেতু ওয়েবসার্ভারের লিংকের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয় সেহেতু ডাইনামিক QR কোড দেখতে অনেকটা কম ঘন দেখায়।
❏ QR কোড কি? QR কোড কিভাবে কাজ করে?
,যে কিউআর কোড তৈরি হয়ে যাবার পরে তার ভেতরের কোন তথ্য পরিবর্তন করা যায় না তাকে স্ট্যাটিক QR কোড বলে। স্ট্যাটিক QR কোডের তথ্য উক্ত কিউআর কোডের প্যাটার্নের মধ্যেই সংরক্ষিত থাকে যার কারণে স্ট্যাটিক QR কোডের তথ্য দেখতে কোন ইন্টারনেট কানেকশন লাগে না। তবে তথ্যের পরিমাণ যত বেশি হবে, স্ট্যাটিক QR কোড দেখতে তত ঘন হবে ও স্ক্যান করতে সমস্যা হবে।
❏ QR কোড স্ক্যানার ডাউনলোডঃ
Google play store এ অনেক অ্যাপ রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে QR কোড স্ক্যান করতে পারবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি QR & Barcode Scanner অ্যাপটি ব্যবহার করি। চাইলে আপনিও করতে পারেন। এটির মাধ্যমে আপনি কিউআর কোড এবং Bar code উভয়ই স্ক্যান করতে ও তৈরিও পারবেন।
কিউআর কোড আধুনিক যুগের একটি অত্যন্ত কার্যকরী ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি। এর দ্রুত এবং সহজ ব্যবহারের জন্য এটি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিউআর কোড আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, এবং ভবিষ্যতে এর ব্যবহার আরও বিস্তৃত হবে বলে আশা করা যায়।
আশা করছি এই পোস্টের মাধ্যমে QR কোড সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা দিতে পেরেছি আপনাদের। QR code তৈরি করতে গিয়ে যদি কোন সমস্যাই পড়েন বা এই পোস্টের কোন অংশ যদি বুঝতে না পারেন তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।




